ঢাকা ০৯:০৫ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৫ জুন ২০২৫, ১১ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
ভোলাগঞ্জে রেলের বাঙ্কারেই চলছে পাথর লুট

নিরাপত্তা বাহিনীর সামনেই ‘ওপেন সিক্রেট’ পাথর পাচার, আদায় হচ্ছে চাঁদাও

সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সীমান্তঘেঁষা ভোলাগঞ্জ এলাকায় অবস্থিত রেলওয়ের মালিকানাধীন পাথর কোয়ারি- যা স্থানীয়ভাবে ‘রেলের বাঙ্কার’ নামে পরিচিত। ৩৫০ একরের এই বিশাল বাঙ্কারটির নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছে রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী (আরএনবি)। পাশাপাশি সীমান্ত এলাকা হওয়ায় বিজিবিও এখানে দায়িত্ব পালন করে।

তবে বাস্তবতা হলো, পাথর উত্তোলন পুরোপুরি নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও এই রেল বাঙ্কার এখন রীতিমতো অবাধ পাথর লুটের এলাকা। চোখের সামনে, নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতিতেই প্রতিদিন শতশত মানুষ পাহাড় ও টিলাভূমি খুঁড়ে তুলে নিচ্ছে মূল্যবান পাথর। আর এই ‘চোখ বুঁজে থাকা’র পেছনে রয়েছে পাথরচক্রের দেওয়া মোটা অঙ্কের টাকা।

স্থানীয় সূত্র ও পাথর শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিদিন শতাধিক নৌকা দিয়ে বাঙ্কার থেকে পাথর তুলে নেওয়া হয়। একেকটি নৌকা দিনে দুই-তিনবার পাথর পরিবহন করে। প্রতিটি নৌকা থেকে আরএনবি সদস্যরা ২০০ থেকে ৩০০ টাকা, আর বিজিবি সদস্যরা ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত নেন। অভিযোগ রয়েছে, এই অর্থ শুধু নিচের সারির সদস্যরাই নন, শীর্ষ কর্মকর্তারাও ভাগ পান।

একজন পাথর শ্রমিক বলেন, “পাথর তোলার আগে আগে টাকা দিয়ে দিতে হয়। না দিলে তোলাই যায় না।” এই চাঁদা আদায়ের জন্য নিরাপত্তা বাহিনীর কিছু সদস্য নিয়মিত উপস্থিত থাকেন। তারা নিজেরাই টাকা সংগ্রহ করেন বা নির্দিষ্ট লোক মারফত আদায় করেন।

ভোলাগঞ্জের রেলের বাঙ্কার এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, শত শত মানুষ কোদাল, বেলচা হাতে মাটি খুঁড়ে পাথর তুলছেন। চারদিকে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য নৌকা। রোদ, বৃষ্টি থেকে বাঁচতে কেউ কেউ বাঁশের খুঁটি ও প্লাস্টিকের ত্রিপল দিয়ে ছাউনি বানিয়ে নিয়েছে। টিলা কেটে কেটে সমতল করা হচ্ছে এলাকা। তৈরি হয়েছে বিশাল বিশাল গর্ত, যা বর্ষায় রীতিমতো ডোবার রূপ নিয়েছে।

এই চোরাই পাথর চলে যাচ্ছে স্থানীয় বাজারে- বিশেষ করে ধলাই নদীর ১০ নম্বর ঘাটসহ আশপাশের ঘাটগুলোতে। সেখানেই চলছে পাথরের অবৈধ কেনাবেচা। মাঝেমধ্যে প্রশাসনের অভিযান হলেও কোনো দীর্ঘমেয়াদি সমাধান আসছে না।

চোরাই পাথর তুলতে যারা জড়িত, তাদের বড় অংশই শ্রমজীবী। কেউ ধান কাটার শ্রমিক, কেউ কৃষি মজুর। যেমন- সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার রহিম আলী কিংবা কাঁঠালবাড়ির কামাল হোসেন। তারা বলেন, “আমরা গরিব মানুষ। রোজগারের কোনো উপায় নেই। তাই ঝুঁকি নিয়েই পাথর তুলি।”

তবে তাদেরও নিয়মিত ‘চাঁদা’ দিতে হয়। অভিযান হলে তারা আগেভাগেই খবর পেয়ে যায়। ফলে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের থেকেও অনেকে এই ‘ব্যবস্থা’ সম্পর্কে ভালো জানেন।

রেলওয়ের নিরাপত্তা বাহিনীর (আরএনবি) একাধিক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, “পাথর উত্তোলনের বিষয়টি ওপেন সিক্রেট। প্রতিটি নৌকা থেকে নির্দিষ্ট হারে টাকা তোলা হয়, যা উপরের মহলে ভাগ চলে যায়। ফলে অনেক কর্মকর্তা চুপ থাকেন।”

আরএনবি পূর্বাঞ্চলের চিফ কমান্ড্যান্ট মো. আশাবুল ইসলাম স্বীকার করেছেন, ভোলাগঞ্জের বাঙ্কার থেকে পাথর লুট হচ্ছে। তবে টাকার বিনিময়ে এই কাজ করতে দেওয়া হয়- এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তিনি।

আরএনবি ঢাকা বিভাগের কমান্ড্যান্ট শফিকুল ইসলাম বলেন, “৫ আগস্টের পর থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। এমনকি ১৪৪ ধারাও জারি করতে হয়েছে। পাথর চোরদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার অভিযোগ খতিয়ে দেখছি।”

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিজিবির সিলেট ব্যাটালিয়নের (৪৮ বিজিবি) অধিনায়ক লে. কর্নেল নাজমুল হক বলেন, “বিজিবির মূল দায়িত্ব সীমান্ত রক্ষা। তবে উপজেলা প্রশাসন চাইলে সহায়তা করা হয়।”

সরকারি সম্পদ রেলওয়ের রেল বাঙ্কার। এটি রাষ্ট্রের সম্পদ। অথচ দিনের আলোয়, প্রশাসনের চোখের সামনে, নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতিতে সেখানে প্রতিনিয়ত লুট হচ্ছে পাথর। এই দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা বন্ধ না হলে দেশের সম্পদ এক সময় নিঃশেষ হয়ে যাবে- থাকবে কেবল গর্ত, ডোবা আর অপূর্ণতা।

 

নতুনকথা/এএস

বিএনপি সর্বোচ্চ ১০ বছর প্রধানমন্ত্রিত্বের পক্ষে

ভোলাগঞ্জে রেলের বাঙ্কারেই চলছে পাথর লুট

নিরাপত্তা বাহিনীর সামনেই ‘ওপেন সিক্রেট’ পাথর পাচার, আদায় হচ্ছে চাঁদাও

আপডেট সময় ১১:০৭:২১ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৫ জুন ২০২৫

সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সীমান্তঘেঁষা ভোলাগঞ্জ এলাকায় অবস্থিত রেলওয়ের মালিকানাধীন পাথর কোয়ারি- যা স্থানীয়ভাবে ‘রেলের বাঙ্কার’ নামে পরিচিত। ৩৫০ একরের এই বিশাল বাঙ্কারটির নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছে রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী (আরএনবি)। পাশাপাশি সীমান্ত এলাকা হওয়ায় বিজিবিও এখানে দায়িত্ব পালন করে।

তবে বাস্তবতা হলো, পাথর উত্তোলন পুরোপুরি নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও এই রেল বাঙ্কার এখন রীতিমতো অবাধ পাথর লুটের এলাকা। চোখের সামনে, নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতিতেই প্রতিদিন শতশত মানুষ পাহাড় ও টিলাভূমি খুঁড়ে তুলে নিচ্ছে মূল্যবান পাথর। আর এই ‘চোখ বুঁজে থাকা’র পেছনে রয়েছে পাথরচক্রের দেওয়া মোটা অঙ্কের টাকা।

স্থানীয় সূত্র ও পাথর শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিদিন শতাধিক নৌকা দিয়ে বাঙ্কার থেকে পাথর তুলে নেওয়া হয়। একেকটি নৌকা দিনে দুই-তিনবার পাথর পরিবহন করে। প্রতিটি নৌকা থেকে আরএনবি সদস্যরা ২০০ থেকে ৩০০ টাকা, আর বিজিবি সদস্যরা ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত নেন। অভিযোগ রয়েছে, এই অর্থ শুধু নিচের সারির সদস্যরাই নন, শীর্ষ কর্মকর্তারাও ভাগ পান।

একজন পাথর শ্রমিক বলেন, “পাথর তোলার আগে আগে টাকা দিয়ে দিতে হয়। না দিলে তোলাই যায় না।” এই চাঁদা আদায়ের জন্য নিরাপত্তা বাহিনীর কিছু সদস্য নিয়মিত উপস্থিত থাকেন। তারা নিজেরাই টাকা সংগ্রহ করেন বা নির্দিষ্ট লোক মারফত আদায় করেন।

ভোলাগঞ্জের রেলের বাঙ্কার এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, শত শত মানুষ কোদাল, বেলচা হাতে মাটি খুঁড়ে পাথর তুলছেন। চারদিকে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য নৌকা। রোদ, বৃষ্টি থেকে বাঁচতে কেউ কেউ বাঁশের খুঁটি ও প্লাস্টিকের ত্রিপল দিয়ে ছাউনি বানিয়ে নিয়েছে। টিলা কেটে কেটে সমতল করা হচ্ছে এলাকা। তৈরি হয়েছে বিশাল বিশাল গর্ত, যা বর্ষায় রীতিমতো ডোবার রূপ নিয়েছে।

এই চোরাই পাথর চলে যাচ্ছে স্থানীয় বাজারে- বিশেষ করে ধলাই নদীর ১০ নম্বর ঘাটসহ আশপাশের ঘাটগুলোতে। সেখানেই চলছে পাথরের অবৈধ কেনাবেচা। মাঝেমধ্যে প্রশাসনের অভিযান হলেও কোনো দীর্ঘমেয়াদি সমাধান আসছে না।

চোরাই পাথর তুলতে যারা জড়িত, তাদের বড় অংশই শ্রমজীবী। কেউ ধান কাটার শ্রমিক, কেউ কৃষি মজুর। যেমন- সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার রহিম আলী কিংবা কাঁঠালবাড়ির কামাল হোসেন। তারা বলেন, “আমরা গরিব মানুষ। রোজগারের কোনো উপায় নেই। তাই ঝুঁকি নিয়েই পাথর তুলি।”

তবে তাদেরও নিয়মিত ‘চাঁদা’ দিতে হয়। অভিযান হলে তারা আগেভাগেই খবর পেয়ে যায়। ফলে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের থেকেও অনেকে এই ‘ব্যবস্থা’ সম্পর্কে ভালো জানেন।

রেলওয়ের নিরাপত্তা বাহিনীর (আরএনবি) একাধিক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, “পাথর উত্তোলনের বিষয়টি ওপেন সিক্রেট। প্রতিটি নৌকা থেকে নির্দিষ্ট হারে টাকা তোলা হয়, যা উপরের মহলে ভাগ চলে যায়। ফলে অনেক কর্মকর্তা চুপ থাকেন।”

আরএনবি পূর্বাঞ্চলের চিফ কমান্ড্যান্ট মো. আশাবুল ইসলাম স্বীকার করেছেন, ভোলাগঞ্জের বাঙ্কার থেকে পাথর লুট হচ্ছে। তবে টাকার বিনিময়ে এই কাজ করতে দেওয়া হয়- এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তিনি।

আরএনবি ঢাকা বিভাগের কমান্ড্যান্ট শফিকুল ইসলাম বলেন, “৫ আগস্টের পর থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। এমনকি ১৪৪ ধারাও জারি করতে হয়েছে। পাথর চোরদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার অভিযোগ খতিয়ে দেখছি।”

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিজিবির সিলেট ব্যাটালিয়নের (৪৮ বিজিবি) অধিনায়ক লে. কর্নেল নাজমুল হক বলেন, “বিজিবির মূল দায়িত্ব সীমান্ত রক্ষা। তবে উপজেলা প্রশাসন চাইলে সহায়তা করা হয়।”

সরকারি সম্পদ রেলওয়ের রেল বাঙ্কার। এটি রাষ্ট্রের সম্পদ। অথচ দিনের আলোয়, প্রশাসনের চোখের সামনে, নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতিতে সেখানে প্রতিনিয়ত লুট হচ্ছে পাথর। এই দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা বন্ধ না হলে দেশের সম্পদ এক সময় নিঃশেষ হয়ে যাবে- থাকবে কেবল গর্ত, ডোবা আর অপূর্ণতা।

 

নতুনকথা/এএস