ঢাকা ০৬:১২ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৪ জুন ২০২৫, ১০ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

শিক্ষা ব্যবস্থায় বড় ক্ষত তৈরি করেছে সংক্ষিপ্ত সিলেবাস ও অটোপাস

  • নিজস্ব সংবাদ :
  • আপডেট সময় ০৬:৪৬:৫০ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৬ জুন ২০২৫
  • ২১ বার পড়া হয়েছে

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের জেরে ২০২০ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অটোপাস দিয়েছিল তৎকালীন সরকার। আর ২০২১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) ও সমমানের পরীক্ষা এবং উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) ও সমমানের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে। সর্বশেষ শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে জুলাই আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে স্থগিত হওয়া ২০২৪ সালের এইচএসসির পরীক্ষাগুলোয় অটোপাস দেয় অন্তর্বর্তী সরকার। চলতি বছরের এইচএসসি পরীক্ষাও অনুষ্ঠিত হবে পুনর্বিন্যাসকৃত সিলেবাস অনুযায়ী। শিক্ষক, অভিভাবকসহ শিক্ষার নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০২০ সালের পর থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে অটোপাস, সিলেবাস সংক্ষিপ্তকরণের মতো ঘটনা শিক্ষার মানে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. হাফিজুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘উচ্চশিক্ষার বিষয়বস্তু ভালোভাবে আয়ত্ত করার জন্য শিক্ষার্থীদের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে একটা ভালো ভিত্তি গড়ে ওঠা অত্যন্ত জরুরি। করোনাকালে অটোপাস, সিলেবাস সংক্ষিপ্তকরণের মতো সিদ্ধান্তের কারণে এ জায়গাটিতে বড় ধরনের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। এখন আমরা ক্লাসে যখন শিক্ষার্থীদের পড়াচ্ছি তখন অনেক শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে দেখতে পাই, তারা এমন অনেক বিষয় বুঝতে পারছেন না যেটি তাদের উচ্চ মাধ্যমিক স্তরেই শিখে আসার কথা। এছাড়া আগের শিক্ষার্থীদের তুলনায় বর্তমান শিক্ষার্থীদের মধ্যে অমনোযোগিতার হারও বেশি।

বিরূপ পরিস্থিতি তৈরি হলে বিকল্প পদ্ধতি ভাবলেও কোনো বোর্ড পরীক্ষায় ছাড় দেয়া ঠিক নয় বলে মনে করেন এ শিক্ষাবীদ। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কখনো বিরূপ পরিস্থিতি তৈরি হলে আমাদের বিকল্প পদ্ধতি ভাবতে হবে। কিন্তু মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে অটোপাস বা সিলেবাস সংক্ষিপ্তকরণের মতো সিদ্ধান্ত কোনো অবস্থায়ই কাম্য নয়। এটি শুধু শিক্ষার্থীদের জন্যই ক্ষতিকর নয়, বরং দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার পরিপ্রেক্ষিতে বিবেচনা করলে দেশের জন্যও ক্ষতিকর।’

২০২০ সালে এসএসসিতে অটোপাস দেয়ার পর ২০২১ সালে এসএসসি ও সমমানের তিনটি এবং এইচএসসি ও সমমানের ছয়টি বিষয়ে পরীক্ষা নেয়া হয়। সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে প্রতিটি বিষয়ের পরীক্ষা ছিল ৩২ নম্বরের। পরের বছরও এসএসসি ও এইচএসসি উভয় পরীক্ষাই হয় সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে। ওই বছর এসএসসিতে ছয়টি এবং এইচএসসিতে সাতটি বিষয়ের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। আবশ্যিক বিষয়ে ৫০ নম্বরের, ব্যবহারিক আছে এমন বিষয়ে ৪৫ নম্বরের আর ব্যবহারিক নেই এমন বিষয়ে ৫৫ নম্বরের পরীক্ষা হয়েছিল। পরের বছর থেকে সব বিষয়ে পূর্ণ নম্বরের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হলেও তা নেয়া হয় সংক্ষিপ্ত সিলেবাসের অধীন। ২০২৪ সালেও এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা হয় সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে।

বর্তমানে দেশের বিভিন্ন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্নাতক পর্যায়ে অধ্যয়নরতরা উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পার হয়েছেন অটোপাস বা সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে আগের শিক্ষার্থীদের তুলনায় তারা তুলনামূলক খারাপ ফল করছেন। এছাড়া বিভিন্ন বিষয় বুঝতে তাদের অধিক সময় প্রয়োজন হচ্ছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. শামীমা সুলতানা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমরা স্নাতক পর্যায়ে যাদের পড়াচ্ছি তারা সবাই-ই ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে নিজেদের প্রমাণ করে এসেছেন। তারা নিঃসন্দেহে মেধাবী। তবে এর পরও তাদের অনেকের মধ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের ঘাটতিটা বোঝা যাচ্ছে। আমরা যখন পরীক্ষার খাতায় শিক্ষার্থীদের উত্তর মূল্যায়ন করি তখন তাদের অনেকের লেখা তুলনামূলক দুর্বল মনে হয়। এর প্রভাব অনেক সময় ফলাফলেও দেখা যায়। এছাড়া এসব শিক্ষার্থীর অনেকের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি রয়েছে। অটোপাস বা সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষার বিষয়গুলো নিয়ে তারা নিজেরাও হীনম্মন্যতায় ভোগেন।’

হীনম্মন্যতায় ভোগার বিষয়টি উঠে এসেছে শিক্ষার্থীদের বক্তব্যেও। ইমরান আহমেদ নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘অটোপাসের বিষয়টি নিয়ে চার বছর পর এসেও কথা শুনতে হয়। এখন ভালো ফল করলেও সবার কাছে এইচএসসির বিষয়টিই যেন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমি শঙ্কিত কোথাও চাকরির আবেদন করলে হয়তো এ বিষয়টি বিরূপ প্রভাব ফেলবে।’

আন্তঃশিক্ষা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে ১১টি শিক্ষা বোর্ডে এইচএসসি পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ১৩ লাখ ৬৭ হাজার ৩৭৭। এছাড়া ২০২১ সালে পরীক্ষার্থী ছিল ১৩ লাখ ৯৯ হাজার, ২০২২ সালে ১৩ লাখ ৩১ হাজার ৫৮, ২০২৩ সালে ১৩ লাখ ৫৯ হাজার ৩৪২ ও ২০২৪ সালে ১৪ লাখ ৫০ হাজার ৭৯০ জন। সে হিসাবে গত পাঁচ বছরে প্রায় ৭০ লাখ শিক্ষার্থী তাদের উচ্চ মাধ্যমিক স্তর শেষ করেছেন অটোপাস বা সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে। শিক্ষকদের মতে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি কলেজগুলোয় অটোপাসের বিরূপ প্রভাব আরো বেশি দেখা যাচ্ছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বলেন, ‘করোনা-পরবর্তী ব্যাচগুলোর শিক্ষার্থীদের পড়াতে গিয়ে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়েছে। এমনও হয়েছে শিক্ষার্থীকে একটি বিষয় বোঝানোর জন্য আমার নবম-দশম শ্রেণীর সংশ্লিষ্ট বিষয় আগে বুঝিয়ে নিতে হয়েছে। যদি সঠিকভাবে পরীক্ষায় মূল্যায়ন করা হতো তাহলে অর্ধেক শিক্ষার্থীও পরবর্তী সেমিস্টারে উত্তীর্ণ হতে পারত না।’

অটোপাস দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় খুবই বিরূপ প্রভাব ফেলেছে বলে মনে করেন ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক একেএম ইলিয়াস। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘২০২০ সাল-পরবর্তী সময়ে স্নাতক পর্যায়ে এক-দুই বিষয়ে ফেল করেছে এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে। তাদের পরবর্তী সময়ে আবার পৃথকভাবে পরীক্ষা নিয়ে পাস করাতে হচ্ছে। এছাড়া ক্লাসে যখন পড়ানো হয় তখন অনেক শিক্ষার্থীরই যেকোনো বিষয় বুঝতে তুলনামূলক বেশি সময় দরকার হয়।’

একই অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন অধ্যাপক ইলিয়াস উদ্দিন আহাম্মদও। দীর্ঘদিন দেশের বিভিন্ন সরকারি কলেজে অধ্যাপনার পর বর্তমানে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। বণিক বার্তাকে অধ্যাপক ইলিয়াস উদ্দিন বলেন, ‘ক্লাসে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ঘাটতিটা যেমন চোখে পড়ার মতো, তেমনি জাতীয় পর্যায়ে এর বিরূপ প্রভাব রয়েছে। অটোপাস ও সিলেবাস সংক্ষিপ্ত করার উদাহরণগুলো শিক্ষার্থীদের পরবর্তী সময়েও এ ধরনের দাবি উত্থাপনে উৎসাহিত করেছে। তাই শিক্ষা ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষাগুলোর বিষয়ে এ ধরনের সিদ্ধান্ত কখনই কাম্য নয়।’

পরীক্ষা না নিয়ে শিক্ষার্থীদের পরবর্তী শ্রেণীতে উত্তীর্ণ করে দেয়া কখনই গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্ত নয় বলে মনে করেন ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘পরীক্ষা ছাড়া পাস করালে শিক্ষার্থীদের দুই ধরনের ক্ষতি হয়—প্রথমত, শিক্ষার্থীদের জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ঘাটতি তৈরি হয়। এমন অনেক বিষয় তাদের অজানা থেকে যায়, যা ওই স্তরে তাদের শেখার কথা ছিল এবং তাদের পড়ালেখার আগ্রহ ও উৎসাহ কমে যায়। দ্বিতীয়ত, কর্মক্ষেত্র ও সমাজে তাদের গ্রহণযোগ্যতা কমে যায়। তারা একধরনের চিহ্নিত হয়ে যায়। পরবর্তী শিক্ষার স্তরগুলো উত্তীর্ণ হলেও তাদেরকে তুলনামূলক কম দক্ষ মনে করা হয়। ফলে এর একটা বিরূপ প্রভাব পড়ে তাদের কর্মজীবনে।’

শিক্ষার্থীরা সঠিকভাবে দক্ষতা অর্জন করতে না পারলে রাষ্ট্রও ক্ষতিগ্রস্ত হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘একবার এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া হলে বারবার এমন দাবি আসে। আমাদের উচিত ছিল করোনার সময়ে এক বছর পর হলেও পরীক্ষা নিয়েই শিক্ষার্থীদের পরবর্তী শ্রেণীতে উত্তীর্ণ করা। সেক্ষেত্রে একই সঙ্গে দুই বছরের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার ব্যবস্থা করা যেত এবং শিক্ষার্থীদের ক্ষতি কমিয়ে আনতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া যেত। কিন্তু যেভাবে পরীক্ষা ছাড়া এবং কম পড়িয়ে শিক্ষার্থীদের উত্তীর্ণ করে দেয়া হয়েছে সেটি উচিত হয়নি।’

শিক্ষা ব্যবস্থায় বড় ক্ষত তৈরি করেছে সংক্ষিপ্ত সিলেবাস ও অটোপাস

আপডেট সময় ০৬:৪৬:৫০ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৬ জুন ২০২৫

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের জেরে ২০২০ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অটোপাস দিয়েছিল তৎকালীন সরকার। আর ২০২১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) ও সমমানের পরীক্ষা এবং উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) ও সমমানের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে। সর্বশেষ শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে জুলাই আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে স্থগিত হওয়া ২০২৪ সালের এইচএসসির পরীক্ষাগুলোয় অটোপাস দেয় অন্তর্বর্তী সরকার। চলতি বছরের এইচএসসি পরীক্ষাও অনুষ্ঠিত হবে পুনর্বিন্যাসকৃত সিলেবাস অনুযায়ী। শিক্ষক, অভিভাবকসহ শিক্ষার নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০২০ সালের পর থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে অটোপাস, সিলেবাস সংক্ষিপ্তকরণের মতো ঘটনা শিক্ষার মানে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. হাফিজুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘উচ্চশিক্ষার বিষয়বস্তু ভালোভাবে আয়ত্ত করার জন্য শিক্ষার্থীদের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে একটা ভালো ভিত্তি গড়ে ওঠা অত্যন্ত জরুরি। করোনাকালে অটোপাস, সিলেবাস সংক্ষিপ্তকরণের মতো সিদ্ধান্তের কারণে এ জায়গাটিতে বড় ধরনের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। এখন আমরা ক্লাসে যখন শিক্ষার্থীদের পড়াচ্ছি তখন অনেক শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে দেখতে পাই, তারা এমন অনেক বিষয় বুঝতে পারছেন না যেটি তাদের উচ্চ মাধ্যমিক স্তরেই শিখে আসার কথা। এছাড়া আগের শিক্ষার্থীদের তুলনায় বর্তমান শিক্ষার্থীদের মধ্যে অমনোযোগিতার হারও বেশি।

বিরূপ পরিস্থিতি তৈরি হলে বিকল্প পদ্ধতি ভাবলেও কোনো বোর্ড পরীক্ষায় ছাড় দেয়া ঠিক নয় বলে মনে করেন এ শিক্ষাবীদ। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কখনো বিরূপ পরিস্থিতি তৈরি হলে আমাদের বিকল্প পদ্ধতি ভাবতে হবে। কিন্তু মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে অটোপাস বা সিলেবাস সংক্ষিপ্তকরণের মতো সিদ্ধান্ত কোনো অবস্থায়ই কাম্য নয়। এটি শুধু শিক্ষার্থীদের জন্যই ক্ষতিকর নয়, বরং দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার পরিপ্রেক্ষিতে বিবেচনা করলে দেশের জন্যও ক্ষতিকর।’

২০২০ সালে এসএসসিতে অটোপাস দেয়ার পর ২০২১ সালে এসএসসি ও সমমানের তিনটি এবং এইচএসসি ও সমমানের ছয়টি বিষয়ে পরীক্ষা নেয়া হয়। সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে প্রতিটি বিষয়ের পরীক্ষা ছিল ৩২ নম্বরের। পরের বছরও এসএসসি ও এইচএসসি উভয় পরীক্ষাই হয় সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে। ওই বছর এসএসসিতে ছয়টি এবং এইচএসসিতে সাতটি বিষয়ের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। আবশ্যিক বিষয়ে ৫০ নম্বরের, ব্যবহারিক আছে এমন বিষয়ে ৪৫ নম্বরের আর ব্যবহারিক নেই এমন বিষয়ে ৫৫ নম্বরের পরীক্ষা হয়েছিল। পরের বছর থেকে সব বিষয়ে পূর্ণ নম্বরের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হলেও তা নেয়া হয় সংক্ষিপ্ত সিলেবাসের অধীন। ২০২৪ সালেও এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা হয় সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে।

বর্তমানে দেশের বিভিন্ন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্নাতক পর্যায়ে অধ্যয়নরতরা উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পার হয়েছেন অটোপাস বা সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে আগের শিক্ষার্থীদের তুলনায় তারা তুলনামূলক খারাপ ফল করছেন। এছাড়া বিভিন্ন বিষয় বুঝতে তাদের অধিক সময় প্রয়োজন হচ্ছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. শামীমা সুলতানা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমরা স্নাতক পর্যায়ে যাদের পড়াচ্ছি তারা সবাই-ই ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে নিজেদের প্রমাণ করে এসেছেন। তারা নিঃসন্দেহে মেধাবী। তবে এর পরও তাদের অনেকের মধ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের ঘাটতিটা বোঝা যাচ্ছে। আমরা যখন পরীক্ষার খাতায় শিক্ষার্থীদের উত্তর মূল্যায়ন করি তখন তাদের অনেকের লেখা তুলনামূলক দুর্বল মনে হয়। এর প্রভাব অনেক সময় ফলাফলেও দেখা যায়। এছাড়া এসব শিক্ষার্থীর অনেকের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি রয়েছে। অটোপাস বা সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষার বিষয়গুলো নিয়ে তারা নিজেরাও হীনম্মন্যতায় ভোগেন।’

হীনম্মন্যতায় ভোগার বিষয়টি উঠে এসেছে শিক্ষার্থীদের বক্তব্যেও। ইমরান আহমেদ নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘অটোপাসের বিষয়টি নিয়ে চার বছর পর এসেও কথা শুনতে হয়। এখন ভালো ফল করলেও সবার কাছে এইচএসসির বিষয়টিই যেন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমি শঙ্কিত কোথাও চাকরির আবেদন করলে হয়তো এ বিষয়টি বিরূপ প্রভাব ফেলবে।’

আন্তঃশিক্ষা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে ১১টি শিক্ষা বোর্ডে এইচএসসি পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ১৩ লাখ ৬৭ হাজার ৩৭৭। এছাড়া ২০২১ সালে পরীক্ষার্থী ছিল ১৩ লাখ ৯৯ হাজার, ২০২২ সালে ১৩ লাখ ৩১ হাজার ৫৮, ২০২৩ সালে ১৩ লাখ ৫৯ হাজার ৩৪২ ও ২০২৪ সালে ১৪ লাখ ৫০ হাজার ৭৯০ জন। সে হিসাবে গত পাঁচ বছরে প্রায় ৭০ লাখ শিক্ষার্থী তাদের উচ্চ মাধ্যমিক স্তর শেষ করেছেন অটোপাস বা সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে। শিক্ষকদের মতে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি কলেজগুলোয় অটোপাসের বিরূপ প্রভাব আরো বেশি দেখা যাচ্ছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বলেন, ‘করোনা-পরবর্তী ব্যাচগুলোর শিক্ষার্থীদের পড়াতে গিয়ে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়েছে। এমনও হয়েছে শিক্ষার্থীকে একটি বিষয় বোঝানোর জন্য আমার নবম-দশম শ্রেণীর সংশ্লিষ্ট বিষয় আগে বুঝিয়ে নিতে হয়েছে। যদি সঠিকভাবে পরীক্ষায় মূল্যায়ন করা হতো তাহলে অর্ধেক শিক্ষার্থীও পরবর্তী সেমিস্টারে উত্তীর্ণ হতে পারত না।’

অটোপাস দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় খুবই বিরূপ প্রভাব ফেলেছে বলে মনে করেন ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক একেএম ইলিয়াস। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘২০২০ সাল-পরবর্তী সময়ে স্নাতক পর্যায়ে এক-দুই বিষয়ে ফেল করেছে এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে। তাদের পরবর্তী সময়ে আবার পৃথকভাবে পরীক্ষা নিয়ে পাস করাতে হচ্ছে। এছাড়া ক্লাসে যখন পড়ানো হয় তখন অনেক শিক্ষার্থীরই যেকোনো বিষয় বুঝতে তুলনামূলক বেশি সময় দরকার হয়।’

একই অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন অধ্যাপক ইলিয়াস উদ্দিন আহাম্মদও। দীর্ঘদিন দেশের বিভিন্ন সরকারি কলেজে অধ্যাপনার পর বর্তমানে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। বণিক বার্তাকে অধ্যাপক ইলিয়াস উদ্দিন বলেন, ‘ক্লাসে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ঘাটতিটা যেমন চোখে পড়ার মতো, তেমনি জাতীয় পর্যায়ে এর বিরূপ প্রভাব রয়েছে। অটোপাস ও সিলেবাস সংক্ষিপ্ত করার উদাহরণগুলো শিক্ষার্থীদের পরবর্তী সময়েও এ ধরনের দাবি উত্থাপনে উৎসাহিত করেছে। তাই শিক্ষা ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষাগুলোর বিষয়ে এ ধরনের সিদ্ধান্ত কখনই কাম্য নয়।’

পরীক্ষা না নিয়ে শিক্ষার্থীদের পরবর্তী শ্রেণীতে উত্তীর্ণ করে দেয়া কখনই গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্ত নয় বলে মনে করেন ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘পরীক্ষা ছাড়া পাস করালে শিক্ষার্থীদের দুই ধরনের ক্ষতি হয়—প্রথমত, শিক্ষার্থীদের জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ঘাটতি তৈরি হয়। এমন অনেক বিষয় তাদের অজানা থেকে যায়, যা ওই স্তরে তাদের শেখার কথা ছিল এবং তাদের পড়ালেখার আগ্রহ ও উৎসাহ কমে যায়। দ্বিতীয়ত, কর্মক্ষেত্র ও সমাজে তাদের গ্রহণযোগ্যতা কমে যায়। তারা একধরনের চিহ্নিত হয়ে যায়। পরবর্তী শিক্ষার স্তরগুলো উত্তীর্ণ হলেও তাদেরকে তুলনামূলক কম দক্ষ মনে করা হয়। ফলে এর একটা বিরূপ প্রভাব পড়ে তাদের কর্মজীবনে।’

শিক্ষার্থীরা সঠিকভাবে দক্ষতা অর্জন করতে না পারলে রাষ্ট্রও ক্ষতিগ্রস্ত হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘একবার এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া হলে বারবার এমন দাবি আসে। আমাদের উচিত ছিল করোনার সময়ে এক বছর পর হলেও পরীক্ষা নিয়েই শিক্ষার্থীদের পরবর্তী শ্রেণীতে উত্তীর্ণ করা। সেক্ষেত্রে একই সঙ্গে দুই বছরের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার ব্যবস্থা করা যেত এবং শিক্ষার্থীদের ক্ষতি কমিয়ে আনতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া যেত। কিন্তু যেভাবে পরীক্ষা ছাড়া এবং কম পড়িয়ে শিক্ষার্থীদের উত্তীর্ণ করে দেয়া হয়েছে সেটি উচিত হয়নি।’