দীর্ঘ অনিশ্চয়তার পর বিএনপির রাজনৈতিক অঙ্গনে স্বস্তির বাতাস বইছে। লন্ডনে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠককে ঘিরে বিরাজমান দূরত্ব কমেছে, তৈরি হয়েছে সদ্ভাবনার আবহ। বৈঠক শেষে দুই পক্ষের যৌথ বিবৃতিতেও ফুটে উঠেছে ইতিবাচক সুর। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
তবে দৃশ্যপটের পেছনে এখনো রয়ে গেছে কিছু চ্যালেঞ্জ। ঢাকার দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ইশরাক হোসেনের সমর্থকদের বিক্ষোভ, বিতর্কিত এনবিআর অধ্যাদেশ এবং সরকারি চাকরিজীবীদের ক্ষোভ- এই সবকিছুই লন্ডন বৈঠকে অর্জিত অগ্রগতিকে ব্যাহত করতে পারে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা।
১৩ ফেব্রুয়ারি লন্ডনে আয়োজিত বৈঠকে তারেক রহমান প্রস্তাব দেন, আগামী বছরের রমজানের আগেই জাতীয় নির্বাচন আয়োজন হোক। প্রধান উপদেষ্টা ইউনূসও এপ্রিলের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সীমা দেন, তবে তার শর্ত ছিল- নির্বাচনের আগে সংস্কার ও বিচার প্রক্রিয়ায় দৃশ্যমান অগ্রগতি থাকতে হবে।
বৈঠকে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকেও একই ইচ্ছা প্রকাশ করা হয়। সব মিলিয়ে লন্ডন বৈঠকে একটি অভিন্ন রূপরেখা তৈরি হয়েছে, যেখানে ফেব্রুয়ারি-মার্চের মধ্যে নির্বাচনের দিকেই ধাবিত হচ্ছে রাজনৈতিক কৌশল।
তবে রাজনীতির এই আপাত স্থিতিশীলতার পেছনে জমে উঠছে চাপা ক্ষোভ। বিশেষ করে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় দলীয় বিভাজন ও এনবিআর অধ্যাদেশ ঘিরে উত্তেজনা রাজনীতিকে জটিল করে তুলছে। সচিবালয়ে সরকারি কর্মচারীদের প্রতিবাদ, এনবিআরের ওপর চাপ এবং মাঠের রাজনীতিতে কিছু দলীয় নেতা-কর্মীর বিক্ষোভ- সব মিলিয়ে সরকারকে এখনও বেশ কিছু কাঁটা সরাতে হবে।
আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক মনে করেন, বড় পরিসরের বিচার প্রক্রিয়া বা কাঠামোগত সংস্কার নির্বাচনের আগেই সম্পন্ন সম্ভব নয়। তিনি বলেন, “সংস্কারের কথা বলে নির্বাচন পাঁচ বছর পেছানো যাবে না। বরং নির্বাচনের পর সরকার গঠনের মাধ্যমে বড় সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী পরিস্থিতিকে এখনও অনিশ্চিত বলে আখ্যা দেন। তার মতে, “লন্ডনের সৌহার্দ্যপূর্ণ বৈঠক সত্ত্বেও জামায়াত ও এনসিপির প্রতিক্রিয়া ইতিবাচক নয়। তাছাড়া পরিস্থিতি কোনদিকে যায় তা আগামী দুই মাসেই বোঝা যাবে।”
তিনি আরও বলেন, “অনিশ্চয়তা কাটাতে হলে প্রয়োজন বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য। শুধু চাওয়া-পাওয়ার হিসাব করলে হবে না, ত্যাগের মানসিকতা থাকলেই ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের সম্ভাবনা টিকে থাকবে।”
অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী দৃশ্যমান সংস্কার ও বিচারের ধীরগতিকে প্রধান উদ্বেগের বিষয় হিসেবে দেখছেন। তিনি বলেন, “সরকার এখনও স্থায়ী গুম প্রতিরোধ কমিশন গঠনের কথা বলছে, কিন্তু এতদিন কী করেছে—সেটা প্রশ্নবিদ্ধ। এই মন্থরতা চলতে থাকলে নির্বাচন ঝুলে যেতে পারে।”
অন্যদিকে বিশ্লেষক আশরাফ কায়সার বেশ আশাবাদী। তার মতে, “যৌথ বিবৃতিতে যে সৌহার্দ্যের বার্তা এসেছে, তা বাংলাদেশে বিরল। বিএনপি ডিসেম্বরে নির্বাচন চাইলেও এখন তারা ফেব্রুয়ারিতে রাজি হয়েছে, এটিই রাজনৈতিক পরিণতির ইঙ্গিত দেয়।”
তিনি মনে করেন, বিএনপির প্রতি সম্মানজনক আচরণ ফিরে আসায় দলটির ভিতরে আস্থা জন্মেছে। আর এটিই দেশের রাজনীতিতে স্বস্তির বার্তা দিয়েছে।
লন্ডনে তারেক-ইউনূস বৈঠক একদিকে রাজনৈতিক অচলাবস্থার বরফ গলিয়েছে, অন্যদিকে সামনে ঠেলে দিয়েছে কিছু নতুন চ্যালেঞ্জ। একে ঘিরে যে সম্ভাবনার জানালা খুলেছে, তা ধরে রাখতে হলে প্রয়োজন হবে গঠনমূলক উদ্যোগ, দ্রুত সংস্কার, এবং একটি সর্বজনগ্রহণযোগ্য নির্বাচনের লক্ষ্যে ঐক্যমত গড়ে তোলা।
যে রাজনীতি এতদিন অবিশ্বাস আর অনমনীয়তায় পর্যবসিত হয়েছিল, এখন সেটির নতুন করে পথ খুঁজে পাওয়ার সময়। তবে প্রশ্ন থেকেই যায়- এই ঐকমত্যে স্বস্তি টিকে থাকবে তো?
নতুুনকথা/এএস