ঢাকা ০৬:১৫ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৪ জুন ২০২৫, ১০ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ইরানের হরমুজ প্রণালী বন্ধের সিদ্ধান্ত : যুক্তরাষ্টের বহুমাত্রিক সংকট।

  • নিজস্ব সংবাদ :
  • আপডেট সময় ০২:২১:৫৪ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৩ জুন ২০২৫
  • ১১ বার পড়া হয়েছে

হরমুজ প্রণালী

ইরানের পার্লামেন্ট হরমুজ প্রণালী সাময়িকভাবে বন্ধের একটি প্রস্তাব অনুমোদন করেছে। পারস্য উপসাগর ও ওমান উপসাগরের মাঝামাঝি অবস্থিত এই জলপথটি দিয়ে প্রতিদিন গড়ে বিশ মিলিয়ন ব্যারেল তেল পরিবাহিত হয়, যা বৈশ্বিক জ্বালানি সরবরাহের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ। এই ছোট অথচ কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জলপথ বন্ধ হওয়ার ঘোষণা বিশ্বজুড়ে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক চাপের মুখে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

 

প্রসঙ্গত, ইরানি রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের খবরে বলা হয়, ইরানের পার্লামেন্ট প্রণালী বন্ধের প্রস্তাব অনুমোদন করেছে। এর প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ফক্স নিউজকে বলেন, আমি চীনা সরকারকে বলবো, তারা যেন এ বিষয়ে ইরানকে ফোন করে, কারণ চীন এই প্রণালী দিয়ে বিপুল পরিমাণে তেল আমদানি করে। তিনি আরও বলেন, যদি ইরান এমনটা করে, তাহলে সেটা হবে আরেকটি ভয়ানক ভুল। এটি তাদের জন্য অর্থনৈতিক আত্মহত্যার শামিল হবে।

 

এই মন্তব্য যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগের গভীরতা প্রকাশ করে। বিশ্ববাজারে ইতোমধ্যেই তেলের দাম লাফিয়ে বাড়তে শুরু করেছে। যুক্তরাষ্ট্র যদিও নিজস্ব উৎপাদনে স্বনির্ভরতার পথে রয়েছে, তবুও আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়লে দেশীয় অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জ্বালানি, খাদ্যপণ্য ও শিল্প উৎপাদনের খরচ বেড়ে গিয়ে মূল্যস্ফীতি বাড়ায়। এর প্রভাবে জনগণের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যায় এবং সরকারের উপর রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি হয়।

 

একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বিষয়টি একটি সামরিক কৌশলগত সংকটে পরিণত হয়েছে। হরমুজ প্রণালীতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্ট্রকে নতুন করে নৌবাহিনীর উপস্থিতি বাড়াতে হচ্ছে। বিমানবাহী রণতরী, ড্রোন ও সাবমেরিন মোতায়েন করতে গিয়ে সামরিক ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। ফলে একদিকে যুদ্ধের ঝুঁকি বাড়ছে, অন্যদিকে বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য বজায় রাখার কৌশল হুমকির মুখে পড়ছে।

 

এ পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক মিত্রদের চাহিদাও বেড়েছে। চীন, ভারত, জাপান ও ইউরোপের দেশগুলো চায় এই সংকটের দ্রুত কূটনৈতিক সমাধান হোক। একদিকে তারা ইরানকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়, আবার অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রকেও সামরিক উত্তেজনা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানায়। চীন নিজেও এই প্রণালী দিয়ে দৈনিক বিপুল পরিমাণ তেল আমদানি করে থাকে, তাই তার ভূমিকা এখানে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

 

বিশ্লেষকেরা অবশ্য মনে করছেন, হরমুজ প্রণালী বন্ধের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ক্ষমতা ইরানের পার্লামেন্টের হাতে নয়; বরং সেটি রেভল্যুশনারি গার্ডের মতো নিরাপত্তা বাহিনীর সিদ্ধান্তের উপর নির্ভরশীল। তবুও এই প্রস্তাব পাশের মাধ্যমে তেহরান একটি রাজনৈতিক ও কৌশলগত বার্তা পাঠিয়েছে যে, যদি তাদের জাতীয় স্বার্থে হস্তক্ষেপ করা হয়, তবে তারা বৃহত্তর পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত।

 

অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও এই সংকট যুক্তরাষ্ট্রকে চাপে ফেলছে। মূল্যস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ফলে প্রেসিডেন্ট প্রশাসনের জনপ্রিয়তা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিরোধী দলগুলোর অভিযোগ উঠেছে, আন্তর্জাতিক সংকট মোকাবিলায় বর্তমান সরকার দুর্বলতা দেখাচ্ছে।

 

সব মিলিয়ে হরমুজ প্রণালী নিয়ে ইরানের সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি বহুমাত্রিক সংকট তৈরি করেছে। অর্থনীতি, সামরিক কৌশল, কূটনৈতিক সম্পর্ক এবং অভ্যন্তরীণ রাজনীতি সব দিকেই এই সংকটের গভীর প্রভাব পড়ছে। এই পরিস্থিতি বিশ্ব রাজনীতিকে একটি নতুন সংঘাতের দিকেও ঠেলে দিতে পারে। এখন দেখার বিষয়, যুক্তরাষ্ট্র এই সংকট মোকাবিলায় কোন পথ বেছে নেয় বলে কূটনৈতিক সমঝোতা, না কি শক্তি প্রয়োগ।

 

আবদুল আহাদ মিনার

সাবেক সাধারণ সম্পাদক

বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী।

ইরানের হরমুজ প্রণালী বন্ধের সিদ্ধান্ত : যুক্তরাষ্টের বহুমাত্রিক সংকট।

আপডেট সময় ০২:২১:৫৪ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৩ জুন ২০২৫

ইরানের পার্লামেন্ট হরমুজ প্রণালী সাময়িকভাবে বন্ধের একটি প্রস্তাব অনুমোদন করেছে। পারস্য উপসাগর ও ওমান উপসাগরের মাঝামাঝি অবস্থিত এই জলপথটি দিয়ে প্রতিদিন গড়ে বিশ মিলিয়ন ব্যারেল তেল পরিবাহিত হয়, যা বৈশ্বিক জ্বালানি সরবরাহের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ। এই ছোট অথচ কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জলপথ বন্ধ হওয়ার ঘোষণা বিশ্বজুড়ে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক চাপের মুখে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

 

প্রসঙ্গত, ইরানি রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের খবরে বলা হয়, ইরানের পার্লামেন্ট প্রণালী বন্ধের প্রস্তাব অনুমোদন করেছে। এর প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ফক্স নিউজকে বলেন, আমি চীনা সরকারকে বলবো, তারা যেন এ বিষয়ে ইরানকে ফোন করে, কারণ চীন এই প্রণালী দিয়ে বিপুল পরিমাণে তেল আমদানি করে। তিনি আরও বলেন, যদি ইরান এমনটা করে, তাহলে সেটা হবে আরেকটি ভয়ানক ভুল। এটি তাদের জন্য অর্থনৈতিক আত্মহত্যার শামিল হবে।

 

এই মন্তব্য যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগের গভীরতা প্রকাশ করে। বিশ্ববাজারে ইতোমধ্যেই তেলের দাম লাফিয়ে বাড়তে শুরু করেছে। যুক্তরাষ্ট্র যদিও নিজস্ব উৎপাদনে স্বনির্ভরতার পথে রয়েছে, তবুও আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়লে দেশীয় অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জ্বালানি, খাদ্যপণ্য ও শিল্প উৎপাদনের খরচ বেড়ে গিয়ে মূল্যস্ফীতি বাড়ায়। এর প্রভাবে জনগণের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যায় এবং সরকারের উপর রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি হয়।

 

একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বিষয়টি একটি সামরিক কৌশলগত সংকটে পরিণত হয়েছে। হরমুজ প্রণালীতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্ট্রকে নতুন করে নৌবাহিনীর উপস্থিতি বাড়াতে হচ্ছে। বিমানবাহী রণতরী, ড্রোন ও সাবমেরিন মোতায়েন করতে গিয়ে সামরিক ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। ফলে একদিকে যুদ্ধের ঝুঁকি বাড়ছে, অন্যদিকে বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য বজায় রাখার কৌশল হুমকির মুখে পড়ছে।

 

এ পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক মিত্রদের চাহিদাও বেড়েছে। চীন, ভারত, জাপান ও ইউরোপের দেশগুলো চায় এই সংকটের দ্রুত কূটনৈতিক সমাধান হোক। একদিকে তারা ইরানকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়, আবার অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রকেও সামরিক উত্তেজনা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানায়। চীন নিজেও এই প্রণালী দিয়ে দৈনিক বিপুল পরিমাণ তেল আমদানি করে থাকে, তাই তার ভূমিকা এখানে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

 

বিশ্লেষকেরা অবশ্য মনে করছেন, হরমুজ প্রণালী বন্ধের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ক্ষমতা ইরানের পার্লামেন্টের হাতে নয়; বরং সেটি রেভল্যুশনারি গার্ডের মতো নিরাপত্তা বাহিনীর সিদ্ধান্তের উপর নির্ভরশীল। তবুও এই প্রস্তাব পাশের মাধ্যমে তেহরান একটি রাজনৈতিক ও কৌশলগত বার্তা পাঠিয়েছে যে, যদি তাদের জাতীয় স্বার্থে হস্তক্ষেপ করা হয়, তবে তারা বৃহত্তর পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত।

 

অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও এই সংকট যুক্তরাষ্ট্রকে চাপে ফেলছে। মূল্যস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ফলে প্রেসিডেন্ট প্রশাসনের জনপ্রিয়তা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিরোধী দলগুলোর অভিযোগ উঠেছে, আন্তর্জাতিক সংকট মোকাবিলায় বর্তমান সরকার দুর্বলতা দেখাচ্ছে।

 

সব মিলিয়ে হরমুজ প্রণালী নিয়ে ইরানের সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি বহুমাত্রিক সংকট তৈরি করেছে। অর্থনীতি, সামরিক কৌশল, কূটনৈতিক সম্পর্ক এবং অভ্যন্তরীণ রাজনীতি সব দিকেই এই সংকটের গভীর প্রভাব পড়ছে। এই পরিস্থিতি বিশ্ব রাজনীতিকে একটি নতুন সংঘাতের দিকেও ঠেলে দিতে পারে। এখন দেখার বিষয়, যুক্তরাষ্ট্র এই সংকট মোকাবিলায় কোন পথ বেছে নেয় বলে কূটনৈতিক সমঝোতা, না কি শক্তি প্রয়োগ।

 

আবদুল আহাদ মিনার

সাবেক সাধারণ সম্পাদক

বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী।