কোরবানির ঈদ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে শুধু একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, বরং একটি বড় অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞের সূচনা করে। এই সময় পশুর চামড়া হয়ে ওঠে দেশের ট্যানারি শিল্প, চামড়া-নির্ভর পণ্য উৎপাদন এবং বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। কিন্তু বছর বছর ঈদের পরেই দেখা দেয় এক করুণ দৃশ্য- পথেঘাটে পড়ে থাকে কোটি টাকার চামড়া, মৌসুমি ব্যবসায়ীরা সর্বস্ব হারান, এবং এতিমখানা-মাদ্রাসাগুলো আর্থিক সঙ্কটে পড়ে।
চামড়ার এই বাজার বিপর্যয়ের দায় কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনার ওপর বর্তায় না; বরং এটি রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার ঘাটতি, বাজার নিয়ন্ত্রণে নীতিগত শূন্যতা এবং একটি সুগঠিত সিন্ডিকেট কাঠামোর যৌথ পরিণাম। সরকার প্রতি ঈদে চামড়ার মূল্য নির্ধারণ করলেও বাস্তবে সেই মূল্য কার্যকর হয় না। অনেক জায়গায় বিক্রি হয়েছে সরকারি দামের অর্ধেক বা তারও কমে। কোথাও কোথাও বিক্রেতা চামড়া আড়তে পৌঁছাতে না পেরে রাস্তায় ফেলে দিয়েছেন।
এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন জাগে- যেখানে সরকার চাল, পেঁয়াজ কিংবা চিনির বাজার নিয়ন্ত্রণে সক্রিয় হয়, সেখানে কোরবানির চামড়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে এতো উদাসীনতা কেন?
মৌসুমি ব্যবসায়ীরা এই সময় কয়েকটি চামড়া কিনে স্বল্প মুনাফার আশায় বাজারে আসেন। নিজেদের সঞ্চয় বা ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করেন তারা। কিন্তু বাজারে সিন্ডিকেটের আধিপত্য, আড়তদারদের অনিয়ম এবং প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার কারণে তারা মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েন। বারবার এ ধরনের পরিস্থিতি তাদেরকে চিরতরে এই বাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করছে। এতে শুধু ব্যক্তিগত ক্ষতি নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে একটি গুরুত্বপূর্ণ খাতের ভবিষ্যতও।
চামড়ার বড় একটি অংশ আসে এতিমখানা, মসজিদ ও মাদ্রাসার মাধ্যমে। পূর্বে এই প্রতিষ্ঠানগুলো ঈদের পর চামড়া বিক্রি করে বছরভর খরচ নির্বাহ করত। বর্তমানে চামড়ার ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় তারাও চরম সংকটে পড়েছে। এটি শুধু অর্থনৈতিক বিষয় নয়, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও সামাজিক সহানুভূতির দিক থেকেও গভীর সংকটের ইঙ্গিত বহন করে।
চামড়া প্রক্রিয়াকরণ খাতেও রয়েছে বড় ধরণের নীতিগত দুর্বলতা। হাজারীবাগ থেকে সাভারে স্থানান্তরিত হলেও চামড়া শিল্পনগরীতে এখনো কার্যকর হয়নি কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (CETP)। এর ফলে পরিবেশ সনদ না থাকায় আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের চামড়ার গ্রহণযোগ্যতা কমছে। বিদেশি ব্র্যান্ডগুলো মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। অথচ দেশের ট্যানারি মালিকদের কেউই মাঠপর্যায়ে সরাসরি চামড়া সংগ্রহে যান না, আড়তদারদের মাধ্যমে চামড়া কেনেন। এতে করে বাজারে স্বচ্ছতা আসে না, বরং দালালচক্রই মূল নিয়ন্ত্রণ নেয়।
চামড়ার বাজারকে রক্ষা করতে হলে এখনই কিছু কঠোর ও সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ নিতে হবে:
👉 জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে চামড়া মনিটরিং সেল গঠন করতে হবে, যারা বাজার পর্যবেক্ষণ ও জরুরি হস্তক্ষেপ করতে পারবে।
👉 সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে কঠোর আইন প্রয়োগের মাধ্যমে। চিহ্নিত চক্রগুলোর বিরুদ্ধে দৃশ্যমান ব্যবস্থা নিতে হবে।
👉 ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য স্বল্পসুদের ঋণ ও ব্যবসা-বিমা চালু করতে হবে, যাতে তারা ঝুঁকি মোকাবিলায় সক্ষম হন।
👉 ট্যানারি মালিকদের মাঠ পর্যায়ে সরাসরি অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক করতে হবে, অন্যথায় তাদের লাইসেন্স নবায়নে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া যেতে পারে।
👉 পরিবেশবান্ধব প্রক্রিয়াজাতকরণ নিশ্চিত করে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অর্জনের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে, তা না হলে রপ্তানি বাজার চিরতরে হারাতে হবে।
বাংলাদেশের চামড়ার বাজার এখন একটি নীতিহীনতা ও অব্যবস্থাপনার করুণ চিত্র। কোরবানির এই পবিত্র উৎসব ও এর সাথে সংশ্লিষ্ট অর্থনীতি যেন প্রতিবারই রাষ্ট্রীয় উদাসীনতার শিকার না হয়- সেই নিশ্চয়তা দিতেই হবে। মৌসুমি ব্যবসায়ী থেকে ট্যানারি মালিক পর্যন্ত প্রতিটি অংশীজনকে একটি সমন্বিত কাঠামোর মধ্যে আনা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
চামড়ার বাজারে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হলে চাই দৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও প্রশাসনিক উদ্যোগ। না হলে প্রতিবছরই কোরবানির এই অর্থনৈতিক সম্ভাবনা রয়ে যাবে অপচয় আর অব্যবস্থাপনার ছায়ায়।
নতুনকথা/এএস