বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ হিসেবে চিহ্নিত ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন—এই তিনটি নির্বাচনের বৈধতা, সুষ্ঠুতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বহুদিন ধরেই উঠেছে অসংখ্য অভিযোগ। ভোটারদের ব্যাপক অংশের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়া, প্রশাসনের নির্লজ্জ পক্ষপাত, এবং বিরোধীদলবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে একদলীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার অভিযোগে ভারাক্রান্ত এসব নির্বাচনের সার্বিক প্রক্রিয়া ও প্রভাব পুনর্মূল্যায়নের উদ্যোগ নিয়েছে দেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
এ লক্ষ্যে সরকার একটি পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট স্বাধীন তদন্ত কমিটি গঠন করেছে, যার নেতৃত্বে রয়েছেন হাইকোর্ট বিভাগের সাবেক বিচারপতি শামীম হাসনাইন। কমিটিতে আছেন প্রশাসন, আইন, একাডেমিয়া ও নির্বাচন পর্যবেক্ষণ খাতের অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা—যার মাধ্যমে স্পষ্ট যে এই তদন্তকে নিছক আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং ভবিষ্যতের জন্য কাঠামোগত সংস্কারের প্রেক্ষাপট তৈরি করাই সরকারের উদ্দেশ্য।
২০১৪ সালের নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল প্রধান বিরোধীদল বিহীন। বিএনপি ও তার জোট সেই নির্বাচন বর্জন করেছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার না থাকার অভিযোগে। ফলাফল—১৫৩টি আসনে বিনা ভোটে প্রার্থীদের নির্বাচিত ঘোষণা। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এ ছিল গণতন্ত্রের জন্য এক অন্ধকার মুহূর্ত।
২০১৮ সালের নির্বাচনে অন্তত কিছু বিরোধীদল অংশ নিলেও, সারা দেশে ভোটকেন্দ্র দখল, রাতের আঁধারে ব্যালট পূরণ এবং নির্বাচন কমিশনের নীরব দর্শকের ভূমিকা নিয়ে দেশ-বিদেশে উঠেছিল বিস্তর প্রশ্ন।
সবশেষ ২০২৪ সালের নির্বাচনকে অনেকেই “প্রতীকের গণতন্ত্র” বলে অভিহিত করেছেন। নামমাত্র বিরোধীদল, স্বতন্ত্র প্রার্থী ও দলীয় কোন্দলের ভেতর দিয়ে ফলাফল প্রভাবিত করার অভিযোগ উঠে আসে, যেখানে প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়ে ছিল প্রবল সন্দেহ।
তদন্ত কমিটিকে এ তিনটি জাতীয় নির্বাচনের প্রক্রিয়া, ভোটগ্রহণ, প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা, নির্বাচনী সহিংসতা ও অনিয়মের অভিযোগ নিয়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে বলা হয়েছে। শুধু অতীত বিশ্লেষণ নয়, ভবিষ্যতের জন্য একটি গ্রহণযোগ্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনী কাঠামো তৈরির সুপারিশ করাও তাদের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, এই পদক্ষেপের উদ্দেশ্য হলো গণতন্ত্রকে পুনঃস্থাপন, ভোটার আস্থার সংকট দূর করা এবং কর্তৃত্ববাদী শাসনের পুনরাবৃত্তি রোধ করা।
নির্বাচন বিশ্লেষক ও কমিটির সদস্য ড. মো. আব্দুল আলীম বলেন, “এই তদন্ত শুধু অতীতের বিচার নয়, ভবিষ্যতের জন্য ন্যায্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন কাঠামো তৈরির পথপ্রদর্শক হতে পারে।” তিনি মনে করেন, তদন্তে প্রাপ্ত তথ্য ভবিষ্যতের নির্বাচনী আইন ও সংবিধান সংশোধনের ভিত্তি হিসেবেও কাজ করতে পারে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই তদন্তকে সফল করতে হলে শুধু আনুষ্ঠানিক তদন্ত নয়, বরং গণশুনানি, নাগরিক সমাজ ও রাজনৈতিক দলগুলোর সক্রিয় সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করতে হবে।
এ তদন্ত কমিটির কার্যক্রম সামনে অনেক প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে পারে। প্রথমত, প্রশাসনের ভেতরে থাকা স্বার্থান্বেষী মহলের অনাগ্রহ; দ্বিতীয়ত, ক্ষমতাসীন দলের সাবেক ভূমিকা ঘিরে বিতর্কিত তথ্য উন্মোচনের চাপ; তৃতীয়ত, নিরপেক্ষ তথ্য পাওয়া ও ভুক্তভোগীদের মুখ খুলতে উদ্বুদ্ধ করা।
তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এটি একটি সাহসী পদক্ষেপ—যদি সত্যিকার অর্থেই সরকারের সদিচ্ছা থাকে। একাধিক সূত্র বলছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ভবিষ্যতের নির্বাচন ব্যবস্থাকে জাতীয় ঐকমত্যে পৌঁছানোর মঞ্চে নিতে চায়।
বাংলাদেশে ভোটের অধিকার শুধু সাংবিধানিক বিষয় নয়—এটি রাজনৈতিক অস্তিত্ব, নাগরিক মর্যাদা এবং গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের ভিত্তি। এই তদন্ত কমিটি যদি সত্যিকার অর্থে নিরপেক্ষতা বজায় রেখে কাজ করতে পারে, তবে এটি শুধু এক টুকরো ইতিহাস খতিয়ে দেখা নয়—এটি হতে পারে একটি নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির সূচনা।