নেদারল্যান্ডসের রাজধানী দ্য হেগে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল বহুল আলোচিত ন্যাটো সম্মেলন ২০২৫। ২৪ থেকে ২৫ জুন পর্যন্ত চলা এই দুই দিনব্যাপী সম্মেলন শুধু কূটনৈতিক আলোচনার জায়গা নয়, বরং তা হয়ে ওঠে রাজনৈতিক বিতর্ক, বিক্ষোভ ও ক্ষোভের মিলনস্থল। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বে আয়োজিত এই সম্মেলনে উঠে আসে প্রতিরক্ষা ব্যয়, পারস্পরিক প্রতিশ্রুতি, মধ্যপ্রাচ্য সংঘাত এবং ইউক্রেন ইস্যু—যা জোটকে যেমন নতুন দিকনির্দেশনা দিয়েছে, তেমনি বিভাজনের রেখাও স্পষ্ট করে তুলেছে।
সম্মেলনের প্রথম দিনই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ন্যাটো সদস্য রাষ্ট্রগুলোর প্রতি আহ্বান জানান যে, ২০৩৫ সালের মধ্যে প্রতিরক্ষা খাতে তাদের জিডিপির অন্তত ৫ শতাংশ ব্যয় নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেন, “ন্যাটোকে টিকিয়ে রাখতে হলে সবাইকে সমানভাবে দায়িত্ব নিতে হবে। শুধু আমেরিকা কাঁধে দায়িত্ব নেবে, তা হতে পারে না।” ট্রাম্পের এই বক্তব্যের সঙ্গে কিছু দেশ যেমন ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য সহমত পোষণ করে, অন্যদিকে স্পেন, বেলজিয়াম, স্লোভাকিয়া প্রমুখ দেশ তা স্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করে। একপর্যায়ে দীর্ঘ আলোচনা শেষে একটি আপস সিদ্ধান্তে পৌঁছানো হয়, যেখানে সরাসরি প্রতিরক্ষা খাতে ৩.৫ শতাংশ এবং সহায়ক খাতে ১.৫ শতাংশ ব্যয়ের প্রস্তাব গৃহীত হয়।
কিন্তু সম্মেলনস্থলের বাইরে ছিল এক ভিন্ন চিত্র। দ্য হেগের রাস্তায় কয়েক হাজার মানুষ শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে অংশ নেন। “নো টু ওয়ার, নো টু ন্যাটো”, “স্টপ বোমস, স্টার্ট ডায়ালগ”—এমন স্লোগান নিয়ে বিভিন্ন দেশের নাগরিকরা রাস্তায় নামেন। বিক্ষোভকারীরা বলেন, ন্যাটো আজ আর শুধু প্রতিরক্ষার জোট নয়, এটি অনেক সময় আগ্রাসনের হাতিয়ার হয়ে উঠছে। কেউ বলছিলেন আফগানিস্তানের কথা, কেউ লিবিয়া, কেউ বা আবার ইউক্রেন কিংবা সিরিয়ার কথা তুলে ধরেন। অনেকে তাদের প্ল্যাকার্ডে লিখেছেন, আমরাও ন্যাটোর সদস্য, কিন্তু শুধুই টার্গেট হিসেবে।
এই প্রসঙ্গে একজন ফরাসি মানবাধিকার কর্মী বলেন, আমরা যুদ্ধ চাই না। ন্যাটো আমাদের নিরাপত্তা নয়, বরং অনিশ্চয়তা ও নিঃস্বতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আফগানিস্তান থেকে আগত এক শরণার্থী বলেন, ন্যাটোর নাম করে যারা বোমা ফেলেছে, তাদের জন্য আমার ভাইয়েরা আজ কবরস্থানে।
সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ন্যাটোর আর্টিকেল ৫ সম্পর্কে মন্তব্য করেন, এর মানে কী, তা নির্ভর করে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করেন। এই বক্তব্য ইউরোপীয় নেতাদের মধ্যে তীব্র উদ্বেগ তৈরি করে। ট্রাম্পের ভাষ্যে স্পষ্ট হয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সব সময় সদস্য দেশগুলোর রক্ষায় এগিয়ে আসবে কি না, তা এখন আর নিশ্চয়তা নয়।
এছাড়া, ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধবিরতি নিয়েও ট্রাম্পের দাবি বিতর্ক সৃষ্টি করে। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপেই যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে এবং ইরানের পরমাণু স্থাপনাগুলো “ধ্বংস” করা হয়েছে। অথচ পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রম মাত্র কয়েক মাস পিছিয়েছে, ধ্বংস হয়নি। ফলে ট্রাম্পের বক্তব্য অনেকের কাছে প্রোপাগান্ডা হিসেবে ধরা পড়ে।
এছাড়াও সম্মেলনের একান্ত বৈঠকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বৈঠকে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, সামরিক সহায়তা এবং পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। বৈঠকের পর ট্রাম্প বলেন, ইউক্রেনের নিরাপত্তা মানে ইউরোপের নিরাপত্তা।
অন্যদিকে, সম্মেলনের অন্তর্গত কূটনৈতিক পরিসরে ন্যাটোর মহাসচিব মার্ক রুটে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে জানান, এই সংস্কারের সাহস দেখানো একজন নেতার কাজ। কেউ আগে এটা করেনি। তবে অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মতে, ট্রাম্পের নেতৃত্ব ন্যাটোকে যেমন নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েছে, তেমনি স্নায়ুচাপ ও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বও বাড়িয়ে তুলেছে।
এই সম্মেলনের কেন্দ্র থেকে যেমন উঠে এসেছে প্রতিরক্ষার নতুন ভাষ্য, তেমনি সম্মেলনস্থলের বাইরে সাধারণ মানুষের বিক্ষোভ, কান্না আর যুদ্ধবিরোধী বার্তাগুলো মনে করিয়ে দিয়েছে ন্যাটো কেবল জোট নয়, এটি এমন একটি শক্তি যার প্রভাব বহু সাধারণ মানুষের জীবনে জড়িত। কেউ সেটা দেখেন আশ্রয় হিসেবে, কেউ দেখেন ক্ষতির প্রতীক।
এই দ্বৈত বাস্তবতা নিয়েই শেষ হলো ন্যাটো সম্মেলন ২০২৫। কিন্তু প্রশ্ন রয়ে গেল ন্যাটো কী সত্যিই সব সদস্য ও মানুষকে নিরাপত্তা দিতে পারছে, নাকি সেই নিরাপত্তা নিজেই এখন প্রশ্নবিদ্ধ