বিদ্যুৎ খাতের সংস্কারের অংশ হিসেবে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে করা বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তিগুলো পর্যালোচনা করছে অন্তর্বর্তী সরকার। বিশেষভাবে বেসরকারি খাতের স্বাধীন বিদ্যুৎ উৎপাদক (আইপিপি) কেন্দ্রগুলোর সঙ্গে হওয়া চুক্তিগুলোতে থাকা ‘ক্যাপাসিটি চার্জ’ কমানো বা বাদ দেওয়ার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হচ্ছে। বিদ্যুৎ বিভাগের একাধিক সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে গত শুক্রবার দেওয়া এক পোস্টে বলা হয়, বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি (পিপিএ) পুনর্নিরীক্ষা করা হচ্ছে, যাতে ক্যাপাসিটি পেমেন্টের ধারা বাতিল বা সীমিত করা যায়। কারণ, এ ধরনের চার্জের কারণে দীর্ঘদিন ধরে উৎপাদিত বিদ্যুতের প্রকৃত খরচের তুলনায় সরকারকে বেশি অর্থ গুনতে হয়েছে।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) চেয়ারম্যান প্রকৌশলী রেজাউল করিম বলেন, “আইপিপিগুলোর সঙ্গে বিদ্যমান ট্যারিফ নিয়ে আলোচনা চলছে। চুক্তির আওতায় থাকা ক্যাপাসিটি চার্জ পুরোপুরি বাদ দেওয়া সম্ভব নয়। তবে আমরা সেটি কমিয়ে আনার চেষ্টা করছি। এতে বিদ্যুতের দাম স্থিতিশীল রাখা সম্ভব হবে।”
পিডিবির তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে গ্যাস বা তরল জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য ক্যাপাসিটি পেমেন্ট প্রতি কিলোওয়াট প্রতি মাসে ১০ থেকে ১২ মার্কিন ডলার এবং কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর ক্ষেত্রে ২০ থেকে ২৫ মার্কিন ডলার। আইএমএফ প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সাম্প্রতিক বৈঠকে পিডিবির কর্মকর্তারা জানান, গ্যাস বা তরল জ্বালানিভিত্তিক এক হাজার মেগাওয়াটের বেশি ক্ষমতার একটি কেন্দ্রের ক্ষেত্রে বছরে ১২০ থেকে ১৪০ মিলিয়ন ডলার, আর কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রের ক্ষেত্রে বছরে ২৪০ থেকে ৩০০ মিলিয়ন ডলার ক্যাপাসিটি পেমেন্ট বাবদ অতিরিক্ত ব্যয় হচ্ছে। এ ব্যয় সরকারের ভর্তুকির আওতায় পড়ে, যা কমানো সম্ভব বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সংস্কারের অংশ হিসেবে গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর আইপিপি এবং যৌথ উদ্যোগের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর চুক্তি পর্যালোচনা করতে একটি কমিটি গঠন করা হয়। চলতি বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ফজলুল কবির খানের নেতৃত্বে সব বিদ্যমান পিপিএ পুনর্বিবেচনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
এরই মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। যেমন, বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোর রিটার্ন অন ইক্যুইটি (আরওই) ১২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৬ শতাংশ করা হয়েছে। এতে পিডিবি বছরে ৩১৯ কোটি ৭৩ লাখ টাকা, নওপাজেকো (৬টি প্ল্যান্ট) ১৩৯ কোটি ৯০ লাখ টাকা, এপিএসসিএল (৫টি প্ল্যান্ট) ৭৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকা, ইজিসিবি (৩টি প্ল্যান্ট) ৩২ কোটি ৮৬ লাখ টাকা, আরপিসিএল (৪টি প্ল্যান্ট) ৪৩ কোটি ৪১ লাখ টাকা এবং বিআরপিএল (২টি প্ল্যান্ট) ২৭ কোটি ৭৯ লাখ টাকা সাশ্রয়ের পরিকল্পনা রয়েছে।
এ ছাড়া, স্থায়ী পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ (ওঅ্যান্ডএম) খরচ কমিয়ে ৪৩২ কোটি ৪১ লাখ টাকা, কম প্লান্ট ফ্যাক্টরে পরিচালিত কেন্দ্রগুলোর ক্ষেত্রে ওঅ্যান্ডএম খরচ সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশে নামিয়ে ৫৫ কোটি ৮৫ লাখ টাকা এবং যৌথ উদ্যোগের প্রকল্পগুলোর নির্মাণকালে ইক্যুইটির ওপর আয়ের পরিশোধ বাতিল করে ৬৮৪ কোটি ৫৫ লাখ টাকা সাশ্রয়ের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানি দক্ষতা বাড়াতে প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টায় ১০০ কিলোক্যালরি তাপ হার কমিয়ে আরও ৫৩৯ কোটি ৯৬ লাখ টাকা সাশ্রয় সম্ভব বলে জানিয়েছে পিডিবি। বাংলাদেশ-ভারত ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিআইএফপিসিএল) ছাড়া বাংলাদেশ-চীন পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের (বিসিপিসিএল) জন্য ওঅ্যান্ডএম খরচ যৌক্তিকীকরণের মাধ্যমে ১৬৫ কোটি ৬৭ লাখ টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব। পাশাপাশি আদানি পাওয়ার থেকে কয়লা আমদানির দামও কমানোর জন্য আলোচনা চলছে।
খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, বেসরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোকে স্বেচ্ছায় তাদের পিপিএ পুনর্নিরীক্ষায় অংশ নিতে উৎসাহিত করা হচ্ছে। কারণ, বিদ্যুতের মূল্যে স্বচ্ছতা আনতে এবং অপচয় বন্ধে এসব চুক্তির অসঙ্গতি দূর করা জরুরি।
বর্তমানে পিডিবি প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ১২ টাকায় কিনলেও, তা বিক্রি করতে হচ্ছে ৮ টাকা ৯৫ পয়সায়। ফলে প্রতি ইউনিটে তিন টাকা পাঁচ পয়সা লোকসান দিতে হচ্ছে, যা সরকারের ভর্তুকির মাধ্যমে সমন্বয় করা হয়। দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৮ হাজার মেগাওয়াট হলেও, চাহিদা রয়েছে প্রায় ১৮ হাজার মেগাওয়াটের।
সরকার আশা করছে, বিদ্যুৎ চুক্তির এই পর্যালোচনার ফলে অপ্রয়োজনীয় খরচ কমানো সম্ভব হবে এবং জনগণের ওপর বিদ্যুতের দামের চাপ কিছুটা হলেও লাঘব পাবে।
নতুনকথা/এএস