অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতি(জেএসএস)-এর মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে সংলাপ শুরুর আবহে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদের বক্তব্য : পার্বত্য চুক্তি বাতিলের কথা নয়, এটি ইতিহাস মুছে ফেলার আয়োজন।
“আপনার আর আমার অধিকার” নামে জনমনে এক সর্বনাশা বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে।
এক ইতিহাসের শুরু, আরেক ইতিহাস মুছে ফেলার হুমকি ভাবছেন অনেকেই। এমনি আবহে কিছু ভাবনা…
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর, বাংলাদেশের ইতিহাসে যুক্ত হয়েছিল এক অসাধারণ অধ্যায়-পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি। এটি ছিল একটি রক্তাক্ত ভূখণ্ডে শান্তির বীজ বোনার রাষ্ট্রীয় প্রয়াস; একটি দীর্ঘ রাজনৈতিক সংঘাতকে সহনশীলতার পথে নিয়ে আসার প্রতিশ্রুতি।
কিন্তু ২০২৫ সালে এসে আমরা দেখছি সেই প্রতিশ্রুতি আজ প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ, এক স্বঘোষিত রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক, নাহিদ ইসলাম, সম্প্রতি রাঙ্গামাটিতে ঘোষণা দিয়েছেন-পার্বত্য চুক্তির সময় ফুরিয়েছে। নাকি নতুন একটি ‘চুক্তি’ হবে, যেখানে থাকবে “আপনার আর আমার অধিকার”।
এই বক্তব্য শুনে প্রথমে বিভ্রান্তি তৈরি হয়, পরে উৎকণ্ঠা। কারণ এটি কেবল একটি ছাত্রনেতার হঠকারী উচ্চারণ নয়-বরং এটি একটি সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক প্রতিস্থাপন প্রকল্পের ভাষ্য, যার মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্তশাসনের আকাঙ্ক্ষা, স্বতন্ত্র পরিচিতি ও ঐতিহাসিক অধিকারের ভিত্তিটিকে নস্যাৎ করে দেওয়ার নীলনকশা।
নাহিদ ইসলাম কে? এবং তাঁর বক্তব্যের রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক মূল্য কতটুকু?
নাহিদ ইসলাম একজন ছাত্রনেতা, যার পরিচিতি মূলত “এনসিপি” নামক একটি নতুন গঠিত রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক হিসেবে।
এই সংগঠনটির এখনও নেই কোনও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি, নেই নির্বাচনী ম্যান্ডেট, এবং নেই পার্বত্য জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে সম্মতি বা প্রতিনিধিত্বের বৈধতা। তাহলে প্রশ্ন হলো একটি ছাত্র-ভিত্তিক সংগঠনের নেতা কীভাবে একটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃত, সরকার-স্বাক্ষরিত চুক্তি বাতিলের ঘোষণা দিতে পারেন?
উত্তর অত্যন্ত স্পষ্ট, তিনি পারেন না। তাঁর কথার কোনও সাংবিধানিক ভিত্তি নেই, জনগণের ম্যান্ডেট নেই, রাষ্ট্রীয় বা আঞ্চলিক গ্রহণযোগ্যতাও নেই। তাহলে কেন এমন বক্তব্য?
এটি একটি রাজনৈতিক বিভ্রান্তি তৈরির প্রচেষ্টা-সেটলারদের “সমান অধিকারের” নামে পাহাড়িদের “বিশেষ মর্যাদা” বিলুপ্তির প্রথম পদক্ষেপ।
“আপনার আর আমার অধিকার”: ভাষার রাজনৈতিক ব্যাকরণ।
নাহিদের কথায় বারবার এসেছে-“আপনার আর আমার অধিকার”। শুনতে সমতার কথা মনে হলেও, এর ভিতরে লুকিয়ে আছে এক ভয়ংকর জেনারেলাইজেশন।
❝এই ন্যারেটিভের মাধ্যমে তিনি বোঝাতে চাইছেন-পার্বত্য চট্টগ্রাম আর কোনো বিশেষ এলাকা নয়। এটি হবে সকলের জন্য সমান অধিকারের এক অভিন্ন ভূখণ্ড-সেটলার হোক বা আদিবাসী, সবার অধিকার এক।❞
এতটা সরলীকরণ আসলে বিপজ্জনক। কারণ, রাষ্ট্র কাঠামোতে সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরু সমানভাবে প্রতিযোগিতা করতে পারে না। বিশেষ পরিস্থিতিতে সংরক্ষণ ব্যবস্থা না থাকলে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী, তাদের সংস্কৃতি, রাজনীতি, প্রশাসন-সব হারিয়ে যায় সংখ্যার গিলে খাওয়ার নিয়মে।
কাজেই, সমান অধিকারের নামে যখন ‘বিশেষ মর্যাদা’ বিলুপ্ত হয়-তখন তা বৈষম্যেরই নতুন নাম।
চুক্তি বাতিলের বক্তব্য: রাজনৈতিক অজ্ঞতা, নাকি পরিকল্পিত আঘাত?
নাহিদ ইসলামের চুক্তি বাতিলের দাবি আসলে রাজনৈতিক অজ্ঞতা কিন্তু চেতনার ধ্বংস। এটি একটি স্বীকৃত চুক্তিকে অস্বীকার করা, সংবিধানের ২৮(৪) ধারার অপমান, এবং জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক সম্প্রদায়ের কাছে বাংলাদেশের দায়িত্বশীল অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করা।
পার্বত্য পাহাড়ি আদিবাসী সম্প্রদায়ের লোকজন ভুলে যেতে পারে না-১৯৯৭ সালের চুক্তি কেবল কাগজে লেখা হয়নি। এটি হয়েছে রক্ত, অশ্রু, এবং স্বপ্ন দিয়ে।
এই চুক্তির মাধ্যমে স্বীকৃতি পেয়েছিল:
পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্তশাসন কাঠামোর প্রথম রূপরেখা
আঞ্চলিক ও জেলা পরিষদের বিকাশ
ভূমি সমস্যা সমাধানের প্রতিশ্রুতি
নিরাপত্তা কাঠামোর অসামরিকীকরণ
পাহাড়িদের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক স্বতন্ত্রতার রক্ষাকবচ।
এনসিপি বা নাহিদদের নেই কোনও রাজনৈতিক বা সাংবিধানিক এখতিয়ার। এনসিপি কোনও নির্বাচিত সংগঠন নয়। তাদের হাতে জনগণের ভোট নেই, পার্বত্য এলাকার কোনও জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধি নয় তারা। সুতরাং, তাদের “নতুন চুক্তি”র কথা বলা মানে রাষ্ট্রকে উপহাস করা এবং ইতিহাসকে তামাশায় পরিণত করা।
এই বক্তব্য প্রতীকী নয়-এটি একটি নতুন মতাদর্শিক আগ্রাসন, যেখানে “সকলের জন্য সমান অধিকার” বলে আদিবাসীদের অস্তিত্বই অস্বীকার করা হচ্ছে। আর পিসিজেএসএস (সন্তু) নীরব: কেন এই নিরবতা?
চুক্তির মূল স্বাক্ষরকারী দল পিসিজেএসএস (সন্তু লারমা) আজ এই চুক্তি বাতিলের হুমকির বিরুদ্ধে কোনও সাংগঠনিক প্রতিবাদ করছে না।
সম্ভবত কারণ, দলটি এখন ক্ষমতাসীনদের সাথে চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে সুন্দর ও সৌহার্দ্যপূর্ণ অবস্থানে আছে। অথচ চুক্তি যখনই হুমকির মুখে পড়েছে, তখন পার্বত্য আদিবাসী পাহাড়ি সম্প্রদায়ের লোকজনদের আশা যে, জেএসএস এর তরফ থেকে সবচেয়ে বড় প্রতিবাদ আসবে। সেই ভূমিকায় এখনও তাদের তরফে কোন প্রতিক্রিয়া না থাকায় চুপচাপ চুক্তি প্রতিস্থাপনের পরিবেশকে সহজ করে দিচ্ছে বলে অনেকের অভিমত (তবে, জেএসএস নীরবতার সত্যি সুন্দর একটা মানে আছে। কারন জেএসএস নেতৃত্ব জানে-নাহিদরা সরকারের অংশ নয় এবং ভবিষ্যতে সরকার গঠনের মত অবস্থানেও তারা নেই)। প্রতিস্থাপন যুদ্ধ” শুরু হয়ে গেছে।
আজ বাস্তবতা হলো-পার্বত্য চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নের প্রশ্ন তোলা হচ্ছে না। বরং চলছে এর বিকল্প একটি চুক্তির কথা-যেটি পাহাড় থেকে বিশেষ মর্যাদা মুছে ফেলবে, সেটলারদের জন্য আইনি ভিত গড়ে তুলবে,
আঞ্চলিক পরিষদের ক্ষমতা সীমিত করবে এবং সংরক্ষিত আসন, কোটা ও অগ্রাধিকার তুলে দেবে।
এ এক নিঃশব্দ ‘রিফর্ম’ নয়-এ এক রিসেটলমেন্ট অফ পাওয়ার। পার্বত্য চুক্তির মৃত্যু নয়, বরং এটি রক্ষা করার সময়।
একজন বিশেষজ্ঞ মন্তব্য করেছেন-“পার্বত্য চুক্তি কেবল একটি দলিল নয়; এটি একটি জাতির আত্মপরিচয়ের দলিল, এটি একটি সংগ্রামের মূল্যায়ন। এর সঙ্গে প্রতারণা মানে পাহাড়ে আরেকটি রক্তক্ষয়ী অধ্যায়ের সূচনা।”
আজ পাহাড় চায় না আরেকটি রক্তঝরা ইতিহাস।আজ পাহাড় চায় সচেতনতা, সতর্কতা এবং সংগঠিত গণতান্ত্রিক প্রতিরোধ, যাতে ঐতিহাসিক স্বত্বাধিকার, সাংবিধানিক মর্যাদা ও আত্মপরিচয়ের সংগ্রাম হারিয়ে না যায়।
পার্বত্য চুক্তি পার্বত্য আদিবাসী পাহাড়ি সম্প্রদায়ের লোকজনের ভবিষ্যতের শেষ আশ্রয়-এটি ভাঙা মানে পাহাড়ের মেরুদণ্ড ভাঙা। সতর্ক থাকুন, গণতান্ত্রিকভাবে অধিকার ও দাবি আদায়ের আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত হোন।