চীনা কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিসি) ২০২৫ সালে এসে তাদের প্রতিষ্ঠার ১০৪তম বর্ষে পদার্পণ করেছে। ১৯২১ সালের ১ লা জুলাই সাংহাইয়ের একটি ছোট গোপন বৈঠক থেকে দলটির সূচনা, সেই দল আজ বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ও প্রভাবশালী রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে সিপিসি শুধু চীনের নেতৃত্বেই নয়, বরং রাষ্ট্রের রূপান্তর, অর্থনীতির ভিত্তি নির্মাণ এবং সামাজিক কাঠামোর পুনর্বিন্যাসে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেছে।
চীনের এই রাজনৈতিক অভিযাত্রা ছিল একটি বিস্ময়কর উত্তরণ একটি দরিদ্র, কৃষিনির্ভর সমাজ থেকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে উন্নীত হওয়া। দারিদ্র্য বিমোচন, অবকাঠামো উন্নয়ন, প্রযুক্তি এবং শিক্ষা খাতে ব্যাপক অগ্রগতি এসেছে সিপিসির দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও শৃঙ্খলাবদ্ধ নেতৃত্বের মাধ্যমে। বিশেষ করে দেং জিয়াওপিং-এর অর্থনৈতিক উদারীকরণের পর দেশটি একটি নতুন গতিতে এগিয়ে যায়। আজ, বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী, চীন শিগগিরই একটি উচ্চ-আয় সম্পন্ন অর্থনীতিতে পরিণত হবে।
কিন্তু এই অর্জনের মধ্যেই চীনের রাজনৈতিক বাস্তবতা আরও কঠোর, কেন্দ্রীভূত এবং নিয়ন্ত্রিত রূপ নিচ্ছে। প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বর্তমানে তৃতীয় মেয়াদে সিপিসির সাধারণ সম্পাদক ও রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন, যা পার্টির গঠনতন্ত্র সংশোধনের মাধ্যমে সম্ভব হয়েছে। তাঁর ‘চীনা জাতির মহান পুনর্জাগরণ’-এর দর্শন এখন পার্টির নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়নের কেন্দ্রবিন্দু।
বর্তমানে চীনজুড়ে চালু রয়েছে “আট দফা শৃঙ্খলা” বাস্তবায়নের নতুন পর্যায়ের প্রচারাভিযান, যার লক্ষ্য অপ্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা, আমলাতন্ত্র, ভোগবিলাস ও অপচয় দূর করা। শি জিনপিং এটিকে নতুন যুগে পার্টি সংস্কারের ‘নির্ণায়ক পদক্ষেপ’ বলে উল্লেখ করেছেন। কিছু প্রদেশে স্থানীয় কর্মকর্তারা এখন সফরের সময়ে নিজেদের খাবারের খরচ নিজেই বহন করছেন, যাতে রাষ্ট্রীয় ভাতা অপব্যবহার রোধ হয়।
এই আত্মসংস্কার কেবল আদর্শগত ভাষণে সীমাবদ্ধ নয়—বরং তা পার্টির গভীর কাঠামোয় একপ্রকার নীতি সংস্কার হিসেবেই দেখা হচ্ছে। ২০২৪ সালেই দুর্নীতির অভিযোগে ৯২ জন কেন্দ্রীয় পর্যায়ের কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত হয়েছে। দুর্নীতিবিরোধী অভিযান এখন পার্টির একটি মৌলিক কৌশল, যা সুশাসন ও জনআস্থার ভিত্তি গড়ে তুলছে।
তবে এই কঠোরতা ও শৃঙ্খলা কতটা গণতান্ত্রিক তা নিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রশ্ন বাড়ছে। হংকংয়ে চাপিয়ে দেওয়া নিরাপত্তা আইন, শিনজিয়াংয়ে উইঘুর মুসলিমদের ওপর নজরদারি ও তথাকথিত পুনঃশিক্ষা শিবির নিয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো উদ্বেগ জানিয়ে আসছে। সংবাদমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ এবং বেসরকারি মত প্রকাশের ওপর কড়াকড়ি চীনের রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থাকে ‘রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্রের একচ্ছত্র আধিপত্যে’ রূপ দিয়েছে বলে সমালোচকরা মনে করেন।
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও চীন আজ দ্বৈত ভূমিকা পালন করছে—একদিকে শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী, অন্যদিকে বিকল্প নেতৃত্বের দাবিদার। দক্ষিণ চীন সাগর, তাইওয়ান ইস্যু, এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রযুক্তি ও বাণিজ্যবিরোধ দেশটিকে এক অস্থির কূটনৈতিক বাস্তবতায় ফেলেছে। তবে একইসঙ্গে চীন “বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ” (BRI)-এর মাধ্যমে আফ্রিকা, এশিয়া ও ইউরোপে বিকল্প অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সংযোগ গড়ে তুলছে। রাশিয়া, ইরান, পাকিস্তান, মধ্য এশিয়া ও আফ্রিকার সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করে চীন একটি নতুন বৈশ্বিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার কৌশল নিচ্ছে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি এখন এমন এক মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে, যেখানে তাদের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা, আত্মসংস্কার ও আন্তর্জাতিক কৌশলগত ভারসাম্য বজায় রাখা একইসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি হ্রাস, তরুণদের বেকারত্ব, আবাসন খাতের সংকট ও জনআস্থার চ্যালেঞ্জ সিপিসিকে ভাবিয়ে তুলেছে।
তবুও ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সিপিসি প্রতিকূলতা মোকাবিলায় যে দৃঢ়তা ও অভিযোজন ক্ষমতা দেখিয়েছে, তা বিশ্বে বিরল। শি জিনপিং নিজেই বলেছেন, “আমাদের অবশ্যই চীনের বাস্তবতার ভিত্তিতে মার্ক্সবাদের তত্ত্বগুলোকে সময়োপযোগী করতে হবে এবং একটি নতুন ধাঁচের আধুনিক সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণে অগ্রসর হতে হবে।”
চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ১০৪ বছরের যাত্রা তাই কেবল রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের গল্প নয়; এটি রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ, আদর্শিক সংগ্রাম ও বৈশ্বিক নেতৃত্বের আকাঙ্ক্ষার একটি দিকচিহ্নও বটে।